ভ্রমনের অপ্রাপ্তি -লিংকন ভদ্র
সেটা ছিল ২রা জুন ২০১৭, ৪০ দিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। সেই ছুটিতে আমি ট্রেন দিয়ে বাড়ির পানে রওনা হলাম।২ টি স্টেশন পার হয়েই ট্রেনের ইঞ্জিনে সমস্যা হওয়ার কারনে, ২ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।এর ফলে অনেকেই ট্রেন থেকে বের হয়ে ঘুরতে গেলেও আমি আমার আপন সিটে বসে আছি।কিন্তু আমার সামনের সিট ফাঁকা।হঠাৎ করে একজন সুন্দরী(মোটামোটি) মেয়ে এসে আমার সামনের সিটে বসল।
আমি উনার দিকে না তাকিয়ে , জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে প্রাকৃতিক দৃশ্যপট অবলোকন করছি আর ভাবছি,
হে ঈশ্বর কেন তুমি স্বর্গের মোহ দেখাচ্ছ?
যদি তুমি আমাকে সুস্থতা দান কর তাহলে আমি সমগ্র জীবন এই পৃথিবীতেই থাকতে চাই। ধরুন অামার কথার প্রত্যুত্তরে ঈশ্বর যদি আমাকে বলে,
স্বর্গের সুখের কি তুলনা হয় রে পাগল?
তখন আমি বলব :হে ঈশ্বর আমরা যারা মানুষ তাদেরকে আপনি কোনো কিছুর বিনিময়েই সন্তুষ্ট করতে পারবেন না, যদিনা আমরা স্বয়ং নিজের চাওয়াকে সীমিত করি।
→হঠাৎ ই পাশের সিটে বসা মেয়েটি আমাকে বলল, এই যে শুনুন, আপনাকেই বলছি, কি করে চুপ করে বসে থাকেন? আজব মানুষ তো আপনি।
আমি: মেয়েটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,আসলে আপনি তো অপরিচিত, তাও আবার মেয়ে মানুষ। আগ বাড়িয়ে কথা বললে কি না কি ভাবেন,তাই আরকি...মনে মনে বলতে লাগলাম,, মেয়েটি পাগল না নাতো?
অচেনা একটা ছেলেকে হুট করে এসব কি বলে?
মেয়েটি:আচ্ছা বলুনতো - ট্রেনটার থামার কি দরকার? চলতে থাকুক না অনন্তকাল এবং চলে যাক না শুক্র গ্রহের পানে।
আমি: থামলে সমস্যা কোথায়?আর শুক্র গ্রহে তাপমাত্রা অনেক বেশি এবং বায়ুমন্ডলে প্রায় ৯০% CO2..ওখানে গেলে এমন উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসার আগেই আপনি মারা যাবেন।
মেয়েটি:- অনেক সমস্যা।এই উঠানামা চক্রের জটিলতা দ্বারা বিরক্ত হয়ে গেছি।তাই আমি এই ট্রেনের দ্বারা অনন্তকাল ভ্রমন করতে চাই।
আর আপনার ওসব বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা বাদ দেন তো। আর সবকিছু আমার মত একটু সুন্দর ভাবে ভাবার প্রয়াস করুন। সবকিছুকে জটিলভাবে ভাবলে, কল্পনার সীমাহীন আনন্দ আপনি কি করে লাভ করবেন?কল্পনার তো বাস্তব কোনো ভিত্তিই নেই তবুও তো মানুষ কল্পনার রাজ্যে প্রবেশ করে আনন্দ পায়,তাই না?
আমি:হুম, বুঝতে পারছি।
আর অসম্ভব সুন্দর আপনার চিন্তাধারা।আমিও আপনার মত হওয়ার চেষ্ঠা অবশ্যই করব।
মেয়েটি:আচ্ছা বলুনতো, যদি সত্যিই ট্রেনটা না থামত, তাহলে কি হত?
আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটি একটু বেশিই কল্পনাপ্রবণ এবং অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের সরল মানবী। আমি প্রথমে একটু লজ্জা পাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েই উত্তর দিলাম,
আমি:আপনার মত মানবীর হৃদয়ে ক্ষণিকের জন্যে রোমান্সের হওয়া ঠিকই বয়ে যেত। কিন্তু নেশা কেটে গেলেই আবার ট্রেন থামানোর প্রচেষ্টা আপনি স্বয়ং করতেন।আপনার এটাও জানা উচিত, যে উপযোগের অাধিক্য আপনি ভ্রমনের দ্বারা পাচ্ছেন তা কিন্তু ক্রমাগত ভ্রমনের ফলে হ্রাস পাবে।
মেয়েটি:এমনটা কেন হবে?
আমি :কেননা, সাধারণত পরিবর্তনশীলতাই মানুষের মোট সুখের পরিমান বৃদ্ধির জন্যে দায়ী আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো সুখ প্রাপ্তির মূখ্য মাধ্যম এটি।
ধরে নিন, ট্রেনটা পৃথিবীতে অবিরাম চলছে।
তখন আপনি ভাববেন, ট্রেনটাকে চাঁদের পানে নিয়ে যাওয়া হয় না কেন? পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে বিরক্ত হয়ে গেছি। তাহলে তো চাঁদের বুড়িকে দেখে আসতে পারতাম।
মেয়েটি:সবাই এমন না।
আমি:আপনি নিজেই তো এমন। ট্রেনটা তার স্বাভাবিকতা বজায় রেখে চলছে,কিন্তু আপনার ভাল লাগছে না। কারন আপনার একটু ভিন্নতা চাই।
মেয়েটি:তেমনটা আমি বলিনি,আমি শুধু পরিবর্তীত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম। আপনি কেমন যেন, বেরসিক ধরনের মানুষ।
আমি:সেই যাই বলুননা কেন,? আপনার প্রশ্নগুলা আমার অত্যন্ত ভাল লেগেছে।
মেয়েটি:আরও কিছু প্রশ্ন করি,আমার অজানাকে জানতে ভীষণ ভাল লাগে।
আমি:অবশ্যই, কেন নয়?
মেয়েটি:আমি যদি পাখি হতাম, তাহলে উড়ে-উড়ে সত্যিই চাঁদে চলে যেতে পারতাম এবং চাঁদের বুড়িকে দেখতে পেতাম,তাই না?
আমি:পারতেন না।কারন আপনি যখন টানার দ্বারা বায়ুমণ্ডল অতিক্রম করবেন,তখন আপনার পাখা কাজ করবে না। কারন সেখানে বায়ু নেই। ফলে বায়ুর উপর ভর করে চলতে পারবেন না।
মেয়েটি:অাবার বিজ্ঞান? ধরে নিন না আমি সহজেই চাঁদে চলে যেতে পারব।কেমন মজা হবে বলুন তো??
আমি :ক্ষণিকের আনন্দ এবং গর্বে আপনার মন ভরে যাবে সেটা যেমন সত্য,ঠিক তেমনিভাবেই আপনার একাকিত্ব আপনাকে পৃথিবীতে আসতে বাধ্য করবে সেটাই মিথ্যে নয়। এটা চিরন্তন সত্য যে, আপনি একা সমগ্র বিশ্বজগৎয়ের মালিক হয়েও সাথী ছাড়া কখনোই সুখ পাবেন না।একাকিত্বের যন্ত্রনা রাহুর ন্যায় আপনাকে ঘ্রাস করবেই।
→ বাক্যবিনিময়ের প্রান্তিক পর্যায়ে মেয়েটাকে আমার সত্যিই ভাল লাগতে শুরু করে।আমার অাগ্রহী মন মেয়েটিকে জানতে চায় পূর্ণরুপে।
আমি: আপনার নাম?
ঠিক তখনি ট্রেনের টিটি এসে মেয়েটিকে বলল, আপনার টিকিট দেখি?
মেয়েটি বের করে দিল।
টিটি বলল, আপনি তো অন্য বগিতে, এখনি ট্রেন ছাড়বে, আপনাকে উঠে যেতে হবে।
মেয়েটি ওর নাম না বলে মিষ্টি করে বিদায় জানিয়ে, দেখা হবে বলে চলে গেল।ঠিক তখনি আমার হৃদয়ে অজানা কম্পন অনুভুত হল।যদিও মেয়েটির জানা ছিল, আমাদের দুজনের দেখা হওয়া অদৌ সম্ভব নয়।তবুও কেন বলল, দেখা হবে।সে ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারিনি।
ট্রেন থামার পর আমি অবশ্য মেয়েটাকে খোঁজার চেষ্টা করেছি, কিন্ত কোন লাভ হয়নি।
সর্বোপরি ভ্রমনটা অপ্রাপ্তিতার সহিত সমাপ্তি হল।
No comments