ত্বরিত বিবাহ -লিংকন ভদ্র
সেটা ছিল ৩রা জুন, ২০১৭।
ক্লান্তিকর আর অপ্রাপ্তিতে ভরপুর ট্রেন ভ্রমন শেষে আমি আমার নিজ গ্রামে এসে পৌঁছালাম।আর এসেই জানতে পারলাম,আমার গ্রামের আমার সমবয়সী সব ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেছে।
যদিও বছরতিনেক ছোট, আজাত নামের একটি ছেলেকে আমি অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাখতাম, যাতে সে দ্রুত বিয়ে না করে।প্রায়ই ওকে বিয়ের পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য হাজারো সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করতাম।
কিন্তু কে শুনে কার কথা।আজাদের বয়স ১৮-১৯ হবে হয়ত।এই বয়সে নবযৌবনের জোয়ার যেখানে অপ্রতিরোধ্য, সামান্য উপদেশ সেখানে অকার্যকর হবে সেটাই স্বাভাবিক। আমি নিজেও সে বয়সটা অতিক্রম করে এসেছি।আর এ বয়সটা এমনই যে,আবেগের আকস্মিক আধিক্য যেকোনো ছেলের জন্যেই খুবই ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যা বলে বোঝানো যাবে না।
সেই ছেলেটিও গতকাল স্বর্গীয় প্রেমের অদৃশ্য শক্তির দ্বারা একটি মেয়েকে ৩-৪ মাইল দূরের একটি গ্রাম থেকে নিয়ে এসে পালিয়ে বিয়ে করেছে।বউ নিয়ে সে এখন নিজ বাড়িতেই থাকে।তার বাবা-মা তাকে কিছু বলেনি। কারণ ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ছিল না।
তার দরুন আমিই আমার গ্রামের একমাত্র অবিবাহিত দুর্ভাগা তরুণ।যদিও কখনো-কখনো অভাবের অনুকরণীয় বৈশিষ্ট্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অবুঝ মনের ভেতর বিয়ের ন্যায় কার্য করার বড়ই সাধ জাগ্রত হয়।কিন্তু আমার বাস্তবিক ভাবনা এবং সম্ভাব্য ভবিষৎ ফলাফলের কথা চিন্তা করার পর নিমিষেই আমার সেই ভাবনা ম্লান হয়ে যায়।
আজই ঔই ছেলেটির সাথে আমার দেখা হল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
কি রে ভাই এটা কি করলি তুই?,তোরে এত বুঝাইলাম,এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করা ঠিক না,তুই কিনা অবশেষে সে কাজটাই করে ফেললি!
আজাত:ভাই হয়ে গেছে ব্যাপারটা।আসলে পড়াশোনা তো সেই শৈশবকালেই ছেড়ে দিয়েছিলাম।কাজ করি আর খাই এবং এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াই।আমার মাথার মধ্যে কেনো জানি সব সময় বিয়ে ব্যাপারটাই শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিল।যেহেতু গ্রামে আমার বয়সী আর কোনো ছেলের বিয়ের বাকি নেই।তাই অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তা করতেই পারছিলাম না।
আমি কাঁধে হাত রেখে বললাম,
আরে ভাই যেহেতু তোর অন্য কোনো ভাবার বিষয় নেই, সেহেতু বয়ঃসন্ধিকালে চিন্তায়-চেতনায় এই ধরনের পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক। এতে তোর কোনো হাত নেই।
ছেলেটি:আমি এতসব বুঝিনা। তবে সখিনার সাথে কয়েক মাস আগেই আমার প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল।আর এই প্রেমের সূত্রপাত ফোনালাপ থেকে। এমনকি আমরা দুজন-দুজনকে সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।এদিকে সখিনার বাবা-মা ওর বিয়ের অন্য জায়গায় বিয়ের পাত্রের সন্ধান করছে। ওর বিয়ের কথা শুনে মনটা বড়ই অশান্ত হয়ে গিয়েছিল। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
আর কেন জানি আমার মনে হত এবং অনুভব করতাম যে, মেয়েটি আমায় সত্যিই অনেক ভালবাসে। তাই আমাদের দুজনের সম্মতিতে, পালিয়ে বিয়েটা করে ফেললাম।
আমি একটু মজা করে বললাম,
প্রেম তো ভাই আমিও করি। এজন্যে কি আবার বিয়ে করা লাগবে নাকি?বাস্তবে যেখানে বিয়ের ক্ষেত্রে প্রেমের গুরুত্ব খুবই নগণ্য বরং টাকা-পয়সা এবং বংশপরিচয়ই হচ্ছে মুখ্য।
আজাত:আপনাকে তো কোনোদিনই দেখিনি কোনো মেয়ের সাথে। এমনকি কখনো তো দীর্ঘ ফোনালাপ করতেও দেখিনি।তাহলে আমি কেন বিশ্বাস করব যে, আপনি প্রেম করেন?
আমি:তুই এসব বুঝবি না, অনলাইনয়ে কথা বলা যায়, ফোনে বেশি কথা না বললেও হয়।
ছেলে:আমি এতকিছু বুঝিনা, তবে গত কয়েক মাসে আমি ৮০০০ টাকার ফোনালাপ করেছি।বুঝতে পেরেছ?দুইবছর ধরে পরিবারকে বিয়ে করানোর কথা বলছিলাম,কিন্তু তাদের এ ব্যাপারে কোনো সাড়া নেই।তাই ঘটনাটা একটু তাড়াতাড়ি ঘটিয়ে দিলাম আরকি।সময় নষ্ট করে কষ্ট পেয়ে কি লাভ বলেন।
আমি:বুঝলাম।ভাই তোরা পারিসও বটে।তোদের চিন্তা-ভাবনা অনেক উপরে যা হয়ত আমার বোধগম্যের বাইরে।
আজাত আমি যতটুকু জানি,তুর বয়স তো ১৮ হয়নি।
আর যা শুনলাম সে অনুযায়ী মেয়েটাকে তো মনে হয় বয়সে আরও অনেক ছোট হবে।বয়স কত রে, সখিনার?
আজাত:১৪-১৫ বছর হবে হয়ত,,,তাতে কি? কাগজে বয়সটা বাড়িয়ে বিয়ের কাজটা সেরে ফেললাম। নতুন বিয়ের দরুন ছেলেটির চোখে-মুখে আমি আনন্দের ছায়া দেখতে পেলাম তা কতক্ষণ স্থায়ী হবে ঈশ্বর জানেন।
এই অশিক্ষিত আজাতকে আমি কি করে বোঝাই যে, কাগজে বয়স বাড়ালেই সখিনার মানসিক বা শারীরিক বয়স বাড়বে না।এমনকি সখিনার যে বিয়ের বয়সই হয়নি।
বোঝালেও আমার কথা সে মানবে কেন।
কারণ আশেপাশে এসব বাল্যবিবাহের ঘটনা অহরহ ঘটছে।কিন্তু অতীতের তুলনায় বর্তমানে এর হার অনেকটা কমে গেছে।
আমি চরমভাবে আশাবাদী, বাল্যবিবাহের ন্যায় সামাজিক ব্যাধিসমূহ শিক্ষার আলোর প্রভাবে খুবই শীঘ্রই বিলিন হয়ে যাবে।
এটা বাল্য বিবাহ হয়েও ভুয়া জন্মনিবন্ধনের দরুন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বৈধ হয়ে গেল।আর এর ভুক্তভোগী হবে সখিনার মত অশিক্ষিত মেয়েরা যার দায় আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, রাষ্ট্রীয় কানুন,এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ।
কয়েকদিন পর সখিনার সাথে আমার দেখা হল। সে আমায় চেনে না।
আমি একটু দূর থেকে ওকে দেখছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম,এই বাচ্চা মেয়েটা যার পুতুল খেলার বয়সটা পর্যন্ত অতিক্রান্ত হয়নি, সে কিভাবে সংসার নামক জটিল ধাঁধাঁর সমাধান করতে পারবে। সে কিভাবে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে। আর সে কিভাবেই বা জন্ম দিবে সুস্থ-সবল শিশু।শুনেছি মেয়েটি পড়াশোনা করেনি।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার অভিশাপে তাকে যে তিরস্কার শুনতে হয়নি সে কথা আমি কখনোই বিশ্বাস করব না।কারণ আমি যে প্রত্যক্ষদর্শী।সেইজন্যেই হয়ত যেকোনো উপায়ে স্বামীর গৃহে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা ছিল তার। আর প্রেম?
প্রকৃতপক্ষে সখিনার মত মেয়েরা প্রেম কি সেটা বুঝে উঠতেই পারে না। তারা জীবনে যতটা না ভালবাসা পায় তার থেকে সহস্রগুণ বেশি লাভ করে তিরস্কার, অপমান এবং অশান্তি।
সখিনারাও একদিন পূর্ণ সম্মান, ভালবাসা এবং অধিকার পাবে।এমনকি নিজের ভাল-মন্দের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারবে। তার জন্যে তাদেরকে শিক্ষিত হতে হবে এবং নিজের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
No comments