সৌন্দর্য যখন অভিশাপ -লিংকন ভদ্র
আমি সুজিত। সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি ব্যাংককে চাকরি নিলাম।
আমি আমার পিতামাতার একমাত্র আদরের বাধ্য ছেলে।
আমার পিতা-মাতাকে আমি দেব-দেবীর সমতুল্য মনে করি।
অামি যা কিছুই করিনা কেন, তাদের সর্বদা অবহিত করতাম।
এবার আসল কথায় আসি,আমার মা-বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। তারা তাদের বউমাকে ঘরে তুলতে খুব একটা দেরি করতে চাচ্ছে না।
আমি অবশ্য মেয়েকে দেখিনি। তবে শুনেছি মেয়েটির নাম নাকি প্রমা এবং সে নাকি স্বর্গের অপ্সরীর ন্যায় সুন্দর এবং হাজারো গুণে গুণবতী। আমার পিতামাতার উপর আমার পূর্ণ আস্তা আছে।তারা যা করবেন আমার মঙ্গলের জন্যেই করবেন।
এদিকে আমারও কারো সাথে প্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই।
তাই এই বিয়েতে আমার কোনো অাপত্তি নেই।
২৪ শে এপ্রিল ২০১৮,
আজ প্রমার সাথে আমার বিয়ে। বিয়ের আসরে যে পর্বে বর-কনের শুভদৃষ্টি হয় ঠিক তখনই প্রমাকে আমি প্রথম দেখলাম।
প্রথম দেখায় সেকি অদৃশ্য বৈদ্যুতিক শক যা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। শুভদৃষ্টির প্রারম্ভিক পর্যায়ে আমরা দুজনেই একটু লজ্জা পেলাম।প্রথম দেখা বলে কথা।
কারণ এর আগে কখনো কথা হয়নি আমাদের।
বিয়ের আসরের হরেক রকমের রঙিন আলো আর ওর লম্বা ঘোমটার আড়ালের জন্য ওকে ভালভাবে দেখতে পারি নাই।
২৬ শে এপ্রিল ২০১৮,
আজ আমাদের বাসর রাত।বউদিরা আমাকে জোড় করে বাসর ঘরে ডুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিসে।আমিও ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
আমি একটু লজ্জা পেলাম এবং লক্ষ্য করলাম প্রমা যেন আরও বেশি লজ্জা পাচ্ছে।আর সেটাই স্বাভাবিক।
আমি আস্তে-আস্তে এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলাম এবং ওর সাথে কুশল বিনিময় করে বললাম, ঘোমটাটা খোলে ফেল।
আজ যে প্রমাকে আমি দেখছি সে যেন আমার পূর্বানুমানকে হার মানিয়ে আমাকে এক উত্তাল সাগরে পতিত করেছে।
ওকে আমি পূর্ণিমার চাঁদের সাথে তুলনা করতে চাই না। কারণ পূর্ণিমার চাঁদও অমাবস্যাতিথিতে কিছুদিনের জন্য তার সৌন্দর্য হারায়। বস্তুত সে যে অতুলনীয়। তবুও থাকে আমি তুলনা করতে চাই সূর্যের মধ্যে হওয়া ফিউশন বিক্রিয়ার সাথে যা হাজার কোটি বছর সূর্যকে বাঁচিয়ে রাখবে।
কল্পনার রাজ্য থেকে ফিরে এসে, প্রমাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ প্রমা?
প্রমা আস্তে করে বলল :ভাল।
আমি ওকে আবার জিজ্ঞেস করলাম বয়স কত তোমার?আর পড়াশোনা ততটুকু করেছ?
প্রমা:এ বছর ষোলতে পা দিলাম।
আমি: কি বল তুমি, তুমি তো আমার অনেক ছোট।
প্রমা:কোনো উত্তর দিলনা।
একটু পর খেয়াল করলাম,
তার হস্তযুগল আমাকে প্রণাম করতে আমার দিকে এগিয়ে আনছে।
আমি:আরে থাম! থাম!একি করছ তুমি?
সে একটু বিব্রতবোধ করল আবারও কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকল।
আমি ওকে বললাম,শুন প্রমা আমি তোমার স্বামী। আমি কোনো দেবতা নই যে আমাকে তোমার প্রণাম করতে হবে।তবে বয়সের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে, গুরুজন হিসেবে প্রণাম করতে পার।আমার উত্তর শুনে প্রমা হাসতে লাগল।হঠাৎ তার হাসির জন্যে কিঞ্চিৎ লজ্জায় সে আবার ঘোমটায় আড়াল করল তার মুখ।
এমনই মিষ্টি ওর হাসি যার জন্যে আমি আজীবন তার গোলাম হয়ে থাকতে রাজী।এবং তা যেন আরব্য উপন্যাসের জ্বীনদের দেওয়া মুক্তার ন্যায় যা আমার সমস্থ দুঃখ-কষ্ঠের লাঘব করবে। আর লাজুকতা যে মেয়েদের সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয়, বিষয়টা আমি প্রমাকে দেখেই বুঝতে পারলাম।
আমি:শোন প্রমা, যেহেতু তোমাকে বিয়ে করেই ফেলেছি সেহেতু তোমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে সীমিত জীবনকালকে সার্থক করিতে চাই।
প্রমা আবারও একটু হাসল এবং কোনো জবাব দিল না।
আমি:আর পড়াশোনা ছেড়ে দিলে কেন?
প্রমা একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল: আমার সুন্দর রূপ আমার জীবনের প্রধান অভিশাপ। যা আমার স্বাধীনতা হরণ করে আমাকে পড়াশোনা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছিল।।
আর এই রূপের জন্যেই, পাড়ার ছেলেদের উৎপীড়নে পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। এমনকি এজন্যে আমি আমার পিতা-মাতার গলার কাঁটা ছিলাম যা আজ সফলভাবে অপসারণ হয়েছে।
আমি:তোমার প্রতি তো রীতিমত অন্যায় হয়েছে।এ তো আমাদের সমাজ ব্যবস্থার প্রাচীন ঐতিহ্য যা বিলুপ্তির পথে থাকলেও পূর্ণরূপে হয়নি।
আমি:শুন প্রমা, আমি বাবা-মায়ের বাধ্য ছেলে হলেও অমানুষ নই। আমি তোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিব এবং ভাল বন্ধু হওয়ার চেষ্টা অবশ্যই করব।
প্রমা বলতো, আমার কাছে তুমি কি চাও?আমি পূরন করার চেষ্টা করব।
প্রমা:মানুষের কি আর চাওয়ার শেষ আছে?আবেগের তাড়নায় এ ধরনের কথা
কাউকে বলতে নেই।যদি দিতে না পারেন তাহলে কষ্ট পাবেন।
এরকম সুযোগে দশরথপত্নী কৈকেয়ী কি করেছিল মনে আছে তো। বাচ্চা মেয়েটার বিচক্ষণতা অামাকে মুগ্ধ করেছে।
আমি যে তোমাকে বিশ্বাস করে ঠকতেও রাজী।কারণ কেনো জানি আমি যে তোমাকে সত্যিই অনেক ভালবেসে ফেলেছি।
প্রমা:আজকাল কেন জানি, এই কথাটা আমার কাছে কোনো বিশেষ অর্থ বহন করেনা।
অনেকেই এ কথা আগে বলেছিল আমায়,কেউ বলেছিল সৌন্দর্যের মোহে। কেউ বা বলেছিল উপহাস করতে। আর কেউ বা বলেছিল অপমান করতে।
আমি:আমি প্রেমে পড়েছি তোমার গুণের,পূজারী হতে চাই তোমার রূপের আর ধন্য হতে চাই তোমান সহচর হয়ে।
প্রমা:আসলে আমি এতকিছু বুঝতে পারি না।আর বুঝতেও চাইনা। কারণ বিয়ে যেহেতু একবার হয়েই গেছে সেহেতু আমাকে স্বামীর সাথেই সারাজীবন থাকতে হবে।
আমার মা বলে দিয়েছিল,
স্বামীকে দেবতার ন্যায় সেবা করা, শ্বশুর-শাশুড়ি সহ পরিবারের সকলের মন যুগিয়ে চলা নাকি আমার কর্তব্য।আমি কি পারব সংসার নামক পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানতে।আমি সত্যিই আজ ভীষণ ভীত।
আমি:তোমার সংশয় যথার্থ।শুন প্রমা,তোমার জানা উচিত, তুমি যে অামার অর্ধাঙ্গিনী কোনো দাসী কিন্তু নও।
তুমি হয়ত খেয়াল করনি, তোমাকে পেয়ে আমার পিতা-মাতার যেন মেয়ে জন্ম দেওয়ার আনন্দ লাভ করেছে।
আমরা যারা সুশিক্ষিত মানুষ তাদের হাত ধরেই পরিবর্তন হবে অমানবিক প্রথার, মুক্তি পেয়ে সম্মানিত হবে মেয়েরা আর সমাজ হবে সুন্দর।
প্রমার চোখে আনন্দঅশ্রু দেখে, আমি বললাম মেয়েরা বিয়ের আগে বরের থেকে ছোট থাকলেও বিয়ের কিন্তু তাদের বয়স কিন্তু সমান হয়ে যায়।।বুঝেছ?
প্রমা:বুঝব না কেন? এখন তো আমি তোমার সমবয়সী।
(পড়ার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ)
No comments