অতৃপ্ত আত্মা -লিংকন ভদ্র
আমি ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি বেশ কিছুদিন ধরে বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেছি।যার দরুন অবৈজ্ঞানিক যেকোন বিষয় বা ধারণা আমি বিশ্বাস করতে নারাজ।যেমন অশরীরী আত্মা,ভূত বা তেমন কোন ভিন্ন জগৎয়ের শক্তি বা সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার।এসব তো বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮,
এদিকে অনেকদিন পর আমার বাড়িতে বন্ধু রাজনের আগমনে আজ আমি অত্যন্ত আনন্দিত।রাজন পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও আত্মা এবং ভূতের ব্যাপারে তার বিশেষ আগ্রহের কোনো কমতি নেই।
আমি তার আগ্রহকে সম্মান জানাই।তবে তার মানে এই নয় যে, আমি ভূতকে সমর্থন করি বা বিশ্বাস করি ভয়ানক আত্মার গল্প।
চলুন এবার মূল বিষয়ে আসা যাক।
লোকমুখে শুনে আসতেছি যে,
আমার বাড়ি থেকে মাইল দুয়েক দূরের একটি স্কুলে নাকি ভূত আছে।সেখানে নাকি মধ্যরাতে পথিকগণ নারীদের আর্তনাদ এর শব্দ শুনতে পায় ।
আমি অবশ্য এসব মোটেও বিশ্বাস করিনা।বরং এসব গ্রামের লোকের তৈরি গুজব বলেই মনে করি।
রাজনকে মজা করে বললাম,
তুই তো ভূতের ব্যাপারে অনেক উৎসাহী, চল গভীর রাতে ঔই ভূতুরে স্কুলে যাই।দেখে আসি দু-একটা ভুত পাই কিনা।
লক্ষ্য করলাম, রাজন এ প্রস্তাবে বেশ আগ্রহী এবং সে আমার সাথে যেতে রাজী।
আমি মনস্থির করলাম যে,
যাই হোক, অন্ততপক্ষে একটি রাত আমাকে রাজনের সাথে ঔই স্কুলে থাকতেই হবে।
যার দরুন যদি গ্রামের মানুষ মিথ্যে ভয় থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারে, তাতেই আমাদের কষ্ট সার্থক হবে।
তার আগে স্কুলটার সম্পর্কে কিছু বলে নিই।
স্কুলটার নাম ১নং টিকুরিয়া সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয়।এখানে আমি পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলাম।
স্কুলটি ৪ রাস্তার মোড়ে অবস্থিত এবং সন্ধা হতেই সেখানে ভয়ানক নিরবতা বিরাজ করে।
আমিও রাতে ওখানে আগে কোনোদিনই যাইনি।
শুনেছি ওখানে নাকি আগে শ্মশান ছিল এবং এই শশ্মানে জমিদার অনিরুদ্ধ ঠাকুরের ১০ জন স্রীকে জোর করে চিতার অগ্নিতে দাহ করা হয়েছিল।
বিশেষ করে তার একমাত্র ছোট ভাই জয় ঠাকুর, সমস্থ সম্পত্তি একাই লাভের নিমিত্তে তার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর সতীদাহ প্রথাকে কাজে লাগিয়ে তার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতার ১০ জন স্রীদের মধ্যরাতে তার ভ্রাতার মৃতদেহের সাথে সহমরণে যেতে বাধ্য করেন।
শুনেছি তার পর থেকেই ওখানে নাকি গভীর রাতে পথিকগণ প্রায়শই কয়েকজন মেয়ের আর্তনাদের শব্দ শুনতে পায়।
১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর,
বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে সতিদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করার পর রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথা রদের বছর দুয়েক আগের ঘটনা এটি।
অপরদিকে আমি আর রাজন মাঝরাতে ঔই স্কুলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিছিলাম।এর মধ্যেই আমাদের ভূতুরে স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারটা অনেকে জানতে পেরেছিল।
আমি ২টা চার্জ লাইট,২টা লাঠি এবং স্কুলে বসে সময় কাটানোর নিমিত্তে কিছু মুড়ি- চানাচুর একটা ব্যাগে পুরে নিলাম।
১৬ ফেব্রুআরি ২০১৮,
আমরা রাত ১২ টার দিকে রওনা হলাম।
পথিমধ্যে এক বৃদ্ধ মানুষ আমাদের বলল,বাবারা তোমারা শিক্ষিত হয়ে কেন যে ভূত,প্রেত বা বাইরের জগৎয়ের শক্তিকে বিশ্বাস করো না সেটা তো জানি না।তবে আমি চাই, তোমরা যাতে ওখানে না যাও,কি না কি হয়?
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম, দাদু আমাদের কিছুই হবে না।আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমার জবাবে উনি হতাশ হয়ে উনার ঘরে প্রবেশ করলেন।
আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
এখন বাজে ১২:২০,
আমরা প্রায় স্কুলের নিকটে চলে আসলাম।অমাবস্যাতিথির অন্ধকার রাতের ভয়ানক নিরবতায় অজানা ভয়ে আমাদের গাঁ যেন ছম-ছম করছে।কারো মুখে কোনো টু-শব্দ টুকুও নেই...আমরা আস্তে-আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।আকস্মিক ঘুঘু পাখির ডাকের সাথে ভয়ানক নিরবতা আমার হৃদয়ে আতংকের সঞ্চার করছিল।ভয়ে রাজনেরও চোখ-মুখ শুকিয়ে আসছে।আমি ওকে অভয় দিয়ে বললাম, আরে ভয় কিসের, ভয়ের অবস্থান তো আমাদের দুর্বল হৃদয়ে।
আমি একটু-একটু ভয় পেলেও ওকে বুঝতে দেইনি।
রাত ১২:২৫,
দরজা ধাক্বা দিয়ে সবে মাত্র স্কুলের দক্ষিণ কোণের পরিত্যক্ত কক্ষটিতে প্রবেশ করলাম।
এরপর যা হল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় তবুও ক্ষুদ্র প্রয়াস করলাম মাত্র।
আমরা দুজন যখন কক্ষটিতে প্রবেশ করলাম। ঠিক তখনই অাস্তে-আস্তে অপ্রত্যাশিত সেই ভয়ানক পরিস্থিতির সূচনা হয়।
প্রথমে আমরা দুজন চার্জ লাইট দিয়ে ঘরটা ভালভাবে দেখে নিলাম, দুই চারটা ভাঙ্গা চেয়ার-টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই।
কিন্তু হঠাৎ করেই কয়েকজন নারী কন্ঠের মৃদু শব্দের আর্তনাদে অামাদের বুকের ভেতরটা ধকধক করছিল।পরক্ষণেই মনে হল যে, কেউ হয়ত রেকর্ড করা ভয়ানক আওয়াজের দ্বারা আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে।
ব্যাপারটা রাজনকে বলতে যাব, এমন সময় লক্ষ্য করলাম স্কুল ঘরটা ক্রমান্বয়ে যেন বিলিন হয়ে যাচ্ছে।এবং সার্বিক পরিবেশটা যেন ৮৫ বছর আগের ন্যায় হয়ে যাচ্ছে।
নিজের নেত্রকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।নিজেকে প্রশ্ন করলাম, স্বপ্ন দেখছি নাতো?
নিজের শরীরে স্বয়ং চিমটি কেটে নিশ্চিত হলাম যে, এ কোনো স্বপ্ন নয়,বরং অপ্রত্যাশিত ভয়ংকর বাস্তবতা।
দেখতে-দেখতে সেখানে এক অগ্নিকুন্ড তৈরি হয়েছে। আর তার মধ্য থেকে জনাদশেক জ্বলন্ত মেয়ের অসহ্যকর যন্ত্রনাক্লিষ্ট আর্তনাদে আমারা দুজন ভীষণ ভয় পেয়ে মৃতপ্রায়।সারিবদ্ধভাবে মেয়েগুলো হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অগ্নিতে দাহ হচ্ছিল এবং প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল।এমনকি তারা অলৌকিকভাবে সারা কক্ষে অবাধে বিচরণ করছে।
এদিকে এ দৃশ্য দেখে রাজন জ্ঞান হারাল।আমি যে পালাব, সে শক্তি পাচ্ছি না।এমনকি পা যেন চিরকালের জন্যে ওখানেই আটকে গেছে।
অগ্নিকুন্ড থেকে ১ম সারীর ১ টি মেয়ে বলছে, হে অনিরুদ্ধ ঠাকুর, তুমি আমাাকে ৮ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলে, যখন দাম্পত্য জীবন কি আমি জানতামই না।ঠিক তখনি তোমার সাথে আমার সহমরণ আমাকে যে পীড়া দিয়েছে তা আমার আত্মাকে অল্প কিছু সুখ পাবার তৃষ্ণায় অতৃপ্ত করে রেখেছে।
২য় সারির মেয়েটি বলল, জলন্তু অগ্নির শিখা যখন আমার মস্তক গলিত করেছিল, ঠিক তখনি আমার আত্মা ঔই ধরনের পুরুষ আর এই নির্মম নিয়ম নির্মাতাদের অগ্নিতে পুরিয়ে তৃপ্তি পেতে চায়। তাই তো আমরা প্রত্যেকদিন অপেক্ষা করি পুরুষজাতির প্রাণ হরণের হেতু।
এদিকে আমার জ্ঞান আছে কিন্তু অগ্নির ভেতরের জলন্ত মেয়েগুলোকে বুঝতে দেইনি, ওরা ভেবেছে আমরা হয়ত মারা গেছি।
তারা একে অন্যের কাছে বলাবলি করছে।আমাদের জীবনেন মূল্য যাদের কাছে নাই, তাদের নিঃশেষ না করা পর্যন্ত আমরা তৃপ্ত হব না।
অপর একটি মেয়ে বলছিল, আমি ছোট ঠাকুরকে বলেছিলাম যাতে আমার পুতুলের বিয়েটা দিতে দেয়, তারপর যেন ওরা আমায় চিতায় তোলে। কিন্তু তিনি আমার কোনো কথা শুনেনি।
এদিকে,আমার জীবিত থাকার ব্যাপারটা যে ওরা জানে না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।হয়ত পরে মেরে ফেলবে।তাই
আমি নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ওদের বলতে বাধ্য হলাম।
হে রমনীগণ, আপনারা আপনাদের হৃদয়ে মিথ্যে ঘৃণা পোষে রেখেছেন।
তখনি মেয়েগুলো উনাদের জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে থাকাল। এবং বলল যে," কিভাবে আমাদের ঘৃণা ভুল?
প্রমাণ কর, নইলে তোকে অবশ্যই হত্যা করব।
আমি ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম :এখন আর প্রাচীন কুসংস্কার এর ন্যায় ক্ষতিকর, অপ্রয়োজনীয় প্রথাসমূহকে আমরা পালন করি না।
এখন আমরা অাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অনেক সভ্য। আপনারা শুধু-শুধু মিথ্যে ঘৃনাকে লালন করছেন এবং দীর্ঘাকৃতি করছেন আপনাদের আত্মার মুক্তির পথ।
আমি বেঁচে আছি এটা জেনে আত্মাগুলো অনেক ক্ষেপে গেল এবং হিংস্র রুপ ধারণ করে আমাকে ঘিরে ধরল।
আমি চিৎকার করে বলতে লাগলাম, দয়া করে আপনারা একটু সচেতন চিত্তে আমার কথাগুলো ভেবে দেখবেন।
এর পর কি হল আমার কিছুই মনে নেই।
হয়ত আমরা দুজনই বেহুশ হয়ে পড়েছিলাম।
সকালের রবি যখন আমাদের মুখমন্ডলে এসে পড়ল,ঠিক তখনি আমরা জাগ্রত হয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি চলে আসলাম।
অনেকে অনেক প্রশ্ন করলেও কাউকে কোনো উত্তর দেইনি।
ঔই মেয়েগুলোর জন্যে আমার সত্যিই অনেক খারাপ লাগছে। আমি জানি না,ওরা আমার কথায় ত্যাগ করেছে কিনা তাদের লালিত ঘৃণা বা পেয়েছে কি তারা মুক্তি?
Valo laglo bondhu, amake niye akta golpo lekbe.
ReplyDelete