অপ্রত্যাশিত পরিণাম --সনি সরকার---
জানালার পাশে বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে যাওয়া যায় বলেই ট্রেন জার্নি তিলুর এতো পছন্দ। শুধু প্রকৃতি নয়, তার সাথে সাথে নগর এবং গ্রামীণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের চিত্রও ফুটে উঠে ট্রেন জার্নিতে।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ট্রেনে উঠলেই ঘুম পায় তিলুর।ট্রেনে উঠলেই ঘুমিয়ে পরে সে। আর এভাবেই ট্রেন জার্নিতে তাঁর একটি দুটি নয় বরং পাঁচ-পাঁচটি ফোন হারিয়েছে। বরাবরের মতো অনেক ভেবে-চিন্তে এবারও সিদ্ধান্ত নিলো ট্রেনেই বাড়ি যাবে তিলু।তাই দেরি না করে অনলাইন থেকে ট্রেনের টিকেটও কেটে ফেলেছে তিলু।বাড়ি যাবার দিন ব্যাগ গুছিয়ে রাত ১১ টার মধ্যে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে পৌঁছে যায় তিলু।১১:১৫ মিনিটে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে উঠে যায় তিলু। গন্তব্য নেত্রকোনা।ট্রেনের একেবারে পিছনের কামরায় তিলুর সিট। নিজের সিটে যখন বসতে যাবে তখন সে দেখল জানালার পাশের সিটে একটি ছেলে বসে আছে।তিলু টিকেট চেক করে দেখলো তার সিট জানালার পাশে পরেনি।তাই একটু মন খারাপ হয়ে গেল তিলুর। কিন্তু কি আর করা,নিজের সিটেই বসলো তিলু। দু্-তিন মিনিটের মধ্যেই টেন ছেড়ে দিলো।ঝনঝন শব্দে ট্রেন চলতে শুরু করলো আর জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাস আসতে লাগলো।মৃদু বাতাসে তিলুর মনও ধীরে ধীরে ভালো হতে শুরু করলো। আসলে তিলুর স্বভাবটাই এমন খুব বেশি সময় মন খারাপ করে থাকতে পারে না সে।তিলু মনে মনে ভাবছে , ঘুমিয়ে গেলে আজকেও হয়তোবা তার মোবাইলটি অন্যান্য বারের মতো চুরি হয়ে যেতে পারে। তাঁর ভাই চাকরির প্রথম মাসের স্যালারী দিয়ে এই মোবাইলটি তিলুকে গিফট করেছিল।এই মোবাইলটিতে তাঁর ভাইয়ের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে তাঁর পাশের ছেলেটিকে তিলু জিজ্ঞেস করলো "ভাইয়া আপনি কোথায় যাবেন..?"
ছেলেটি বললো সে নেত্রকোনা যাবে।
তিলু ছেলেটির উত্তর শুনে মনে মনে বেশ খুশি হলো। যেহেতু দুজনের গন্তব্য একই। তাই তিলু একটু আরাম করে ঘুমাতে পারবে।তিলু কোন বণিতা না করে ছেলেটিকে আবারো জিজ্ঞেস করলো, "ভাইয়া আপনি কি জার্নিতে ঘুমান..??"
ছেলেটি না বলাতে তিলু তো মহাখুশি।সে ছেলেটিকে বললো, ভাইয়া আমি হয়তো ঘুমিয়ে পড়তে পারি।যদি এরকমটা হয় তাহলে আপনি যদি একটু কষ্ট করে খেয়াল রাখতেন আমার মোবাইলটি যেন কেউ না নিয়ে যায়। ছেলেটি তিলুর কথা শোনে মনে মনে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো,মনে মনে ভাবছে অদ্ভুত মেয়ে তো। চেনা নাই,জানা নাই, সে ঘুমাবে আর আমি তার মোবাইল পাহারা দিব...!তিলু ছেলেটিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কানের মধ্যে হেডফোন লাগিয়ে সিটের মধ্যে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর তিলু শুনতে পেল ছেলেটি তাকে ডাকছে। তিলু কান থেকে হেডফোন সরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালো।
ছেলেটি বললো আপু আপনি আপনার মোবাইলটি ব্যাগের মধ্যে রেখে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন।আমি সজাগ আছি।তিলু মুচকি হেসে বললো, আচ্ছা ভাইয়া।কিন্তু মনে মনে ভাবছে একটা অপরিচিত ছেলেকে এতটা বিশ্বাস করা কি ঠিক হচ্ছে, ছেলেটি নিজেই তো তিলুর মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে।
যাই হোক না কেনো, অবিশ্বাস করে পুরো ট্রেন জার্নি মাটি করার চেয়ে বিশ্বাস করে কিছুক্ষণ হলেও শান্তিতে থাকার পক্ষপাতী তিলু।
তিলু খুব ভালো করেই জানে ঘুমিয়ে গেলে ইহজাগতিক সবকিছুি ভুলে যায় সে।দুইবছর আগে মাসির বিয়েতে যোগদানের জন্য যখন মামাবাড়ি যাচ্ছিল তখনও সে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রাত ১০:৩০ মিনিটে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসেই উঠেছিল।মাসির বিয়ে বলে কথা, কতো খুশি ছিলো তিলু।টিউশনির কয়েকমাসের টাকা জমিয়ে কিনেছিল রেডমির নতুন মডেলের একটি স্মার্টফোন। কত পরিকল্পনা ছিল বিয়েতে যেয়ে অনেক ছবি তুলবে,ভিডিও করবে।ট্রেনে উঠে ট্রেন ছাড়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তিলু, সে কি ঘুম..!
মনে হচ্ছিল ঘুম ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছু নেই। ট্রেন যখন বিমানবন্দর স্টেশনে থেমেছিল তখনও তিলুর হাতে তাঁর মোবাইলটি ছিল,রাত তিনটায় ট্রেনটি যখন ময়মনসিংহ স্টেশনে থামে তখন ঘুম ভাঙলে তিলু দেখে তাঁর হাতে মোবাইলটি আর নেই।সেদিন তিলু বুঝেছিল একটি মোবাইল হারানো মানে শুধুমাত্র একটি যান্ত্রিক ডিভাইস হারানো নয়, বরং এর সাথে হারিয়ে যায় মোবাইলে ধারণ করা সুন্দর মুহূর্তগুলো,অনেক ভালো এবং খারাপ সময়ের স্মৃতি।চোখবুঁজে এসব ভাবতে ভাবতে তিলুর ঘুম চলে আসছিল,তখনই তাঁর কানে ভেসে আসছিল চানাচুরওয়ালার ডাক,এই চানাচুর... গরম গরম চানাচুর... চানাচুরওয়ালা তার সিটের পাশে আসতেই তার পাশে বসা ছেলেটি বললো "মামা মামা আস্তে বলেন" আমাকে দেখিয়ে ইশারায় বললো ঘুমাচ্ছে। তিলু মনে মনে বেশ অবাক হলো, ভাবছে একটা অপরিচিত ছেলে তার ঘুম নিয়ে এতটা কেন চিন্তা করছে,এর আগেও তো অনেক অপরিচিত মানুষের সাথে জার্নি করেছে সে,কাউকে তো এতটা ভাবতে দেখেনি।তবে কারো কাছে এরকম দরদমাখা গুরুত্ব পেয়ে মনে মনে ভীষণ খুশিই হলো তিলু।কিছুটা আত্মতৃপ্তির সায়রে অবগাহন করে মুচকি হেসে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেল সে।
তিলু ঘুমিয়ে গেলে ছেলেটি তিলুর দিকে তাকালো।তিলু আহামরি কোন সুন্দরী নয়,গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু ট্রেনের কামরার আবছা আলো ছায়ার মধ্যে তিলুকে অনন্য মায়াবী মনে হচ্ছিল।তিলুর মুখের দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলেটি মনে মনে ভাবছে এ কোন সাধারণ মেয়ে নয়,এ হচ্ছে ইশ্বরের নিজ হাতে অনেক যত্নে বানানো এক অনন্য নারী।কি নিষ্পাপ মুখ,কি সুন্দর টানা টানা ঘুমন্ত দুটি চোখ। তবে সবথেকে বেশি সুন্দর লাগছিল তিলুর ঠোঁটদুটি, ঘুমের মধ্যেও ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল।যেনো জগতের সমস্থ সুখ তাঁর মাঝে দৃশ্যমান হচ্ছে।
জানালা দিয়ে আসা মৃদু বাতাসে তিলুর চুলগুলো মুখের সামনে উড়ছে।ছেলেটির ইচ্ছে করছিল মুখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে কিন্তু সাহসটুকু পেল না।মনে মনে ভাবলো এই মায়াবী নারীকে সে যদি নিজের করে পেতো তাহলে এত সুন্দর একটা ঘুমন্ত মুখ দেখে হয়তো অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারতো।পরক্ষণেই তাঁর মাথায় আসলো দুর এইসব কি ভাবছে সে,তবুও মনে মনে ভাবলো মেয়েটির ঘুম ভাঙলে পরিচয় টুকু জেনে নিবে।ট্রেন এসে ময়মনসিংহ স্টেশনে থামল, যাত্রীদের হইহট্টগোল, হকারদের ডাকাডাকিতে তিলুর ঘুম ভেঙে গেল।তিলু চোখ খুলেই দেখে নিল মোবাইলটি আছে কিনা,ব্যাগের মধ্যে মোবাইলটি পেয়ে মুচকি হাসলো তিলু।তারপর ছেলেটিকে বললো ভাইয়া চলেন চা খেয়ে আসি, দুজনে মিলে স্টেশনের একটা দোকানে গিয়ে বসলো।তখন রাত প্রায় তিনটা বাজে।চারদিকে শুধুই নিকষ কালো অন্ধকার। স্টেশনের কোলাহল দূর অন্ধকারে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
চা খাওয়ার সময় ছেলেটির পরিচয় জানতে চাইলে সে তিলুকে বললো, তাঁর নাম শোভন, ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে,ফ্যামিলির বড় ছেলে। অসুস্থ মাকে দেখতে বাড়ি যাচ্ছে। ছেলেটি তিলুকে এটাও বললো তাঁর মায়ের খুব ইচ্ছে মৃত্যুর আগে ছেলের বউ দেখে যাবার।ছেলেটির কথা শেষ হলে তিলুও নিজের কথা বলে।তিলু হাসতে ভালোবাসে।যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতেও সে হাসতে পারে।ঘুরতে খুবই পছন্দ করে তিলু।সমুদ্র তাঁর ভীষণ পছন্দ আর অবসর সময়ে উপন্যাস পড়তে ভালোবাসে তিলু।দুজনের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো তাঁরা।ছেলেটি মনে মনে ভাবলো ট্রেনে উঠে তিলুর মোবাইল নাম্বারটি চেয়ে নিবে।ততক্ষণে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল, হুঁইসেলের শব্দ শুনে দুজনেই তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে যায় ট্রেনে উঠার জন্য।তিলু প্রথমে উঠলো। ছেলেটি যখন ট্রেনে উঠতে যাবে তখনই বুঝতে পারলো কেউ একজন পিছন থেকে তাঁর মোবাইলটি নিয়ে দৌড় দিয়েছে।ছেলেটিও তৎক্ষনাৎ ট্রেন থেকে নেমে লোকটির পিছনে দৌড়াতে শুরু করে।তিলু ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে যায়।কি করবে ভেবে উঠার আগেই ট্রেন চলতে শুরু করে।তিলু অন্ধকারে ছুটে চলা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকে আর ট্রেন চলতে থাকে তার নিজ গতিতে।
কঠিন পরিস্থিতিতেও যে মেয়েটি হাসতে জানতো, আজ তার মুখ মলিন হয়ে গেলো।হয়তো এরকম বিচ্ছেদ প্রত্যাশিত ছিলনা।
No comments